“সে কি মামা! আপনি তো ভিজে গেছেন একেবারে।তোয়ালে দিচ্ছি স্নান শেষ করে বিশ্রাম নিন”
“হ্যা গো মা।একদম ভিজে গেছি। আমি আসছি তাহলে”
ভদ্রলোকের বয়স ৬০ এর কাছাকাছি হবে।চেহারায় কেমন যেন মায়া ছড়িয়ে আছে। রোগা ধরনের অনেক টা। বেশ শান্ত মেজাজের।কথাও বলেন গুছিয়ে। মা ছাড়া কোন কথা বলেন না।
” মামা,খেতে আসুন। খাবার বেড়েছি টেবিলে”
আজ ছুটির দিন। নিয়ন ও বাসায়ই আছে।
“তুমিও আসো খেতে। তোমাদের খেতে দিচ্ছি”
খাওয়া পর্ব শেষে আমি সব গুছিয়ে রাখছি।
উনি কারো সাথে কথা বলছে।৷ বেশ অনেক্ক্ষণ ধরে কথা বলছে।
আমি তার রুমে গিয়ে দাঁড়িয়েছি। উনার কথা থেমেছে।সবে রেখেছে ফোন টা।
“চা করবো। আপনি চা খাবেন তো?চিনি কতটুকু খাবেন? ”
” হ্যা হ্যা খাই মা। তুমি দাও! এক চামচ দিলেই হচ্ছে”
“ঠিকাছে”
“বুঝলে মা! মেয়েটা ফোন করেছে। বাচ্চা মেয়ে আমার।এবার নাইনে উঠেছে।বাবা ছাড়া কিছু বোঝে না গো! তাই এতক্ষণ গল্প করে নিলাম। এখন ঘুমোতে গেলো।মেয়ে আমার তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ে।মাথার ব্যারাম আছে তো। দেরি করে ঘুমোলে সকালে ক্লাস করতে পারে না।”
” আচ্ছা আচ্ছা। তাড়াতাড়ি ঘুমনোই ভালো। তা মাথার ব্যামোর জন্য ডাক্তার দেখানো হয় নি,মামা?’
“হ্যা হয়েছে মা। আসলে এত ওষুধ খেতে কি আর ভালো লাগে বলো দেখি! তার উপর বাচ্চা মেয়ে!”
” অসুখ যখন করেছে খেতে তো হবেই। ”
“হ্যা তাই তো সারাক্ষণ বুঝিয়ে খাওয়াই! ”
মেয়েকে প্রচন্ড ভালোবাসে। মেয়ের কথা বলার সময় চোখ একদম চক চক করছিল।৷
” আপনি বসুন,মামা।আমি চা করে আনছি! ”
পরের দিন সকালে উঠতেই দেরি হয়ে গেলো। তড়িঘড়ি করে নাস্তা রেডি করে দুজন কে খেতে দিয়েছি। নিয়নও তাড়াতাড়ি করে অফিসে চলে গেছে। চাও খেয়ে যেতে পারলো না।
সকল কাজ সেরে একটু টিভি দেখতে বসেছি। উনি ও এসে বসলো আমার সাথে।
” জানো মা! আমার মেয়ে নন্দিনী। বড় আদরের মেয়ে আমাদের বুঝলে? বায়না করেছে এবার ওর জন্য যেন রং তুলি নিয়ে যাই।মেয়ে আমার আকতে বড় ভালোবাসে গো! ”
“বাহ বেশ তো।আমি কিনে দিবো না হয় ভালো দেখে।”
” হ্যা দিও মা। খুব মিষ্টি দেখতে আমার নন্দিনী। দাড়াও। তোমাকে দেখাচ্ছি। ”
ফোন বের করে গ্যালারি থেকে বেশ কটা ছবি দেখালো নন্দিনীর।
“বাহ! বেশ মিষ্টি দেখতে তো। ”
” তা বলেছো ঠিকই। মেয়ে আমার বড় লক্ষী।”
আমি মৃদু করে হাসলাম!
” আপনি টিভি দেখুন,মামা। আমি দুপুরের রান্না টা সেরে আসি”
” ঠিকাছে মা”
দুপুরের রান্না শেষ করে দুপুরের খাবার খেতে খেতে সে-ই বেলা বয়ে গেলো। বিকেলে বের হলাম রং তুলি কিনতে। আরো টুকটাক কিছু কেনার ছিল।
বাসায় ফিরেছি সন্ধ্যা বেলায়। কিন্তু উনাকে কোথাও দেখছি না। সে কি! কোথায় গেল!
আমি নিয়নকে ফোন করলাম। নিয়নও বেশ ঘাবড়ে গেল।
কি হলো বুঝলাম না।উনি কই গেলো হঠাৎ!
নিয়ন ফোন করেছে!
” মামা চলে গেছে বুঝলে! ”
সেকি! কিছু না বলেই চলে গেল যে! ”
” অসুস্থ মানুষ।! যা মনে হয়েছে করেছে আর কি! থাকো! রাখছি! বাসায় এসে কথা হবে! ”
কি আর করা। পরে কুরিয়ার করে এই রং তুলি পাঠিয়ে দিতে হবে!
আমি রাতের রান্না সেরে আরাম করে যে-ই একটু শুয়েছি ওমনি কলিংবেলের আওয়াজ। মনে হয় নিয়ন এসেছে।
“বাহ বা।এত তাড়াতাড়ি ফিরেছো আজ! ”
” হুম।কাজের চাপ কম ছিল আর কি”
” হুম। বুঝলাম। খেতে দিবো তোমাকে?”
” না। খিদে নেই। পরে খাই।তুমি না হয় চা করে আনো!”
“ঠিকাছে ফ্রেশ হয়ে নাও। আসছি আমি! ”
চা করে দুজন বসেছি বেলকনিতে।
” আচ্ছা তনী! এসব রং তুলি কার গো?!”
” ওহ! ওগুলো নন্দিনীর জন্য কিনেছিলাম! মামা বললো ও আকতে নাকি খুব ভালোবাসে, তাই আর কি! তুমি এগুলো একটু কুরিয়ারে পাঠানোর ব্যবস্থা করে দিও তো! ”
” হুম। আসলে তনী নন্দিনী মারা গেছে আরো বছর তিনেক আগে”
“সে কি! কী বলছো এসব!”
“হুম। নন্দিনী খুব আদরের মেয়ে ছিল তাদের। মামা জীবনের বেশিরভাগ সময় নন্দিনীর সাথেই কাটিয়েছে।মেয়ে ছিল তার চোখের মণি। রোড অ্যাক্সিডেন্টে মারা গিয়েছিল নন্দিনী।এই ধাক্কা টা মামা একদম সহ্য করতে পারে নি। বেশ কদিন একদম চুপচাপ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু কিছুদিন পরই উনি খুব নরমাল বিহেভ করছিল। উনার মতে নন্দিনী মরে নি। নন্দিনীর সাথে নাকি তার রোজ কথা হয়। মাঝে মাঝে ওকে দেখতেও পায়। ডাক্তার বলেছে এই ট্রমা থেকেই তার সিজোফ্রেনিয়া হয়েছে”
“সিজোফ্রেনিয়া কি গো? ”
” বলতে পারো মানসিক রোগ। এই রোগে আক্রান্তরা অনেক অসম্ভব কিছু অনুভব করে।এমন কি একটা কাল্পনিক চরিত্র বা এমন কোন চরিত্রকে ভাবে যার আসলে কোন অস্তিত্ব নেই। মাঝে মাঝে তাদের খুব হ্যালুসিনেশন হয়। চোখের সামনে অনেক কিছু দেখে, অনেক শব্দ শোনে যা আমরা দেখতে বা শুনতে পাই না”
” হ্যা তা তো বটেই”
“উনার কি কোন ট্রিটমেন্ট চলছে না?”
” হ্যা চলছে শুনেছি।তবে এই শেষ বয়সে এসে উনি এই সিজোফ্রেনিয়া কাটিয়ে উঠতে পারবে কি না তা জানি না! ”
আমার খুব মন খারাপ লাগছে।নিয়ন আমার হাত ধরলো।আমি সেই রং তুলির দিয়ে তাকিয়ে রইলাম। মানুষের জীবন বুঝি এতটাও অদ্ভুত হয়!